অনলাইনে গেমে আসক্তি,তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে সব স্বপ্ন কেড়ে নিচ্ছে স্বজনভাদের

প্রযুক্তির অপব্যবহার-

স্বজন দেশের স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কৈশরে বিয়ে হওয়া তাসনুভা একমাত্র ছেলে তৌকিরের ভবিষ্যৎ চিন্তায় মাদকাসক্ত স্বামীর সংসার ছেড়েছেন বেশ কয়েক বছর আগে। ছেলেকে নিয়েই তার সংসার আর হাজারো স্বপ্ন। কিন্তু তার স্বপ্ন ভেঙে যেতে বসেছে ছেলের মোবাইল ফোনে আসক্তির কারণে।

গত দু-তিন বছর থেকে রাজীবের মোবাইল ফোন ছাড়া আর চলছেই না। পাবজি ও ফ্রি ফায়ার ছাড়াও নানা ধরনের অনলাইন গেমে আসক্ত হয়ে এখন দিনরাত সে ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কারোর সাথে কথা বলে না।ঠিকমতো গোসল করে না। খাবার খায় না। ঘরের বাইরে যেতে চায় না। কারো বাড়িতে যাওয়া বা মাঠে খেলতে যাওয়া তো ভুলে গেছে অনেক আগেই। মাধ্যমিক কোনোরকমে পাস করে সে কলেজে ভর্তির চেষ্টায় রয়েছে।

স্বজনের ছেলের ভবিষ্যৎ চিন্তায় গেমে আসক্তি বন্ধ করার জন্য মোবাইলটা নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এতে সব বিফলে চলে যায়,হয়ে যায় উল্টো। ছেলে মাকে ছেড়ে মাদকাসক্ত বাবার কাছে ফিরে যেতে রাজি আছে তবুও মোবাইল গেম খেলা ছাড়তে একদম রাজি নেই। এমন ঘটনা শুধু স্বজনের পরিবারের নয় দেশের অধিকাংশ পরিবারের এখন এমনই চিত্র।

এখনকার ছোট্ট অবুঝ সন্তানকে মা-বাবা মোবাইল ফোনটা হাতে না দিলে সেও আর খাবার খায় না। ছাত্র-ছাত্রীরা অনলাইনে ক্লাসের নামে পরিবার থেকে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে।কিন্তু লেখাপড়ার পরিবর্তে তারা নানান প্রকার গেমে আসক্ত হয়ে পড়ে। সারারাত জেগে পাবজি ও ফ্রি ফায়ার ছাড়াও নানা ধরনের অনলাইন গেমে সময় কাটিয়ে দিচ্ছে।

সাত বছরের ছেলে আবির থেকে অনার্স পড়ুয়া ২১ বছরের নাফিজ,কেউ এর বাইরে নয়। বেশি করে ছোটদের ফোন নিয়ে নানা ভিডিও দেখা ও ছোটখাটো গেমে সময় পার করলেও বড়রা সবাই এসব অনলাইন গেম নিয়ে সবসময় পড়ে থাকে। অনেক পরিবার আবার বাড়ির ছোট সন্তান মোবাইল ফোনের খুঁটিনাটি সব বিষয় জানায় অনেক গর্ব অনুভব করেন। আর এ থেকেই শুরু হয় আসক্তি। এ নেশা মাদকের চাইতে আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তৌকির ছাড়াও এ বিষয়ে এই প্রতিবেদকের কথা হয় অনলাইন গেমে আসক্ত শতাধিক ছাত্রছাত্রীর সাথে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে যে,পাবজি ও ফ্রি ফায়ার ছাড়াও দেশের কিশোর, তরুণ ও যুবকেরা ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যান, কল অব ডিউটি মোবাইল, কমব্যাট স্ট্রাইক গোসহ নানা ধরনের আরো বেশ কয়েকটি অনলাইন গেমে আসক্ত পরেছে । এসব গেমে গুগল অ্যাকাউন্ট বা ফেসবুক আইডি দিয়ে সাইন ইন করতে হয়। অনেকে গেস্ট আইডি থেকেও এই গেমে অংশ নেয়।ব্রোঞ্জ, সিলভার, গোল্ড, প্লাটিনাম, ডায়মন্ড, হিরোইক ও গ্র্যান্ড মাস্টার নামের এসব খেলায় বিভিন্ন ধাপ বা অবস্থান রয়েছে।

অতি সহজে কেউ হিরোইক ও গ্র্যান্ড মাস্টার পর্যায়ে যেতে পারে না।গ্র্যান্ড মাস্টার পর্যায়ে কেউ যেতে পারলে তাকে এসব গেমের সফটওয়্যার তৈরি বা আরো উন্নত করতে বা খেলার জন্য তাদের নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আর এসব কথা তরুণেরা বিশ্বাস করে। ছাত্রজীবন শেষে কর্মজীবনে ব্যবসা বা চাকরির পাশাপাশি ক্যারিয়ার হিসেবে এসব গেমকে নেয়া যাবে বলেও তাদের বিশ্বাস। ইউটিউব চ্যানেল খুলে সেখানে এসব গেম ছেড়ে দিয়ে প্রচুর আয় করার স্বপ্নও দেখে এ সব তরুণ। চলমান করোনাকাল এসব গেম খেলোয়ারদের কাছে আশীর্বাদ স্বরূপ দেখা দিয়েছে।

বাবা-মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে শুধু ইন্টারনেটই কিনছে তা নয় কিনছে খেলার জন্য ডায়মন্ড টপআপ টাকা দিয়ে অনলাইনে খেলার জন্য বিভিন্ন সামগ্রী। সন্তানকে ঘরে রাখতে করোনাকালে অনেক পরিবার নিজেদের বাসা বাড়িতে  ব্রডব্যান্ড যুক্ত ইন্টারনেট সংযোগ নিয়ে ওয়াইফাই রাউটার বসিয়েছে। বাবা-মায়ের সামনে বসে অনলাইন গেমে অংশ নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করলেও অনেক অভিভাবক কিছুই বুঝতে পারছেন না।

নাটোরের মুদ্রণ শিল্প ব্যবসায়ী মোঃ আব্দুল হান্নান মানিকসহ অনেক অভিভাবক বলেছেন, তাদের মধ্যে  তথ্য-প্রযুক্তির যে জ্ঞান,তার থেকে সন্তানদের জ্ঞান তাদের থেকে কয়েকগুণ বেশি। ফলে সন্তানদের তারা কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। সরকার এসব খারাপ গেম বন্ধ করে তাদের  সন্তানদের জন্য কল্যাণকর কোনো গেম চালু করুক।অন্য কোনো ব্যবস্থা না করলে এ আসক্তি থেকে সন্তানকে দূরে রাখা তাদের নিজেদের পক্ষে সম্ভব নয়।

ব্লু হোয়াইল-এর মতো এসব গেম সরাসরি মৃত্যু না ঘটালেও সন্তানকে আসক্তির মাধম্যে ধাপে ধাপে তার জীবন ঠিকই নষ্ট করে দিচ্ছে। অভিভাবকরা ১৮ বছরের কম বয়সীদের মোবাইল ফোন ব্যবহার বন্ধ করার জন্য সরকাররের কাছে কঠোর আইন তৈরি ও তার প্রয়োগ করার দাবি জানিয়ে বলেন, তবেই এ সমস্যার অনেকটা সমাধান করা সম্ভব হবে।

এসব বিষয় নিয়ে পাবনা মানসিক হাসপাতালের ব্রেইন, মানসিক ও মাদকাসক্ত রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মোঃ মাসুদ রানা সরকার বলেছেন,ইন্টারনেটে এসব গেমের আসক্তি মানুষের বহুবিধ মানসিক সমস্যা সৃষ্টির অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে।এছাড়াও এটা এক ধরনের মানসিক রোগ। ১২ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের এ আসক্তি বেশি। প্র্যাতাহিক, অ্যাকাডেমিক, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কে এদের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। এদের কোনো কিছু মানিয়ে নিতে সমস্যা হয়। চিকিৎসা, ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের যে শিক্ষা তার পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও ছাত্রছাত্রীদের মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য কঠোর নিয়ম তৈরী করে তার সঠিক বাস্তবায়ন করতে পারলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে।

তথ্য-প্রযুক্তি বিষয় নিয়ে কাজ করছেন এবং জাতীয় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও গবেষণা অ্যাকাডেমি (নেকটার) বগুড়ার অতিথি প্রশিক্ষক এ.এস.এম. শামসুজ্জোহা কবীর বলেছেন- বর্তমান প্রজন্ম স্মার্টফোন আর অনলাইনভিত্তিক নানা গেমে আসক্ত হয়ে পড়ছে।এখন ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য  অনেকেই ভিপিএন ব্যবহার করে বিভিন্ন সাইটে যায়।এসব ক্ষেত্রে শিশুর সাথে ভালো-মন্দ বুঝিয়ে বলার দায়িত্বটা তো অভিভাবকের।এখন ইন্টারনেটে প্যারেন্টাল কন্ট্রোলের মাধ্যমে শিশুর গেম খেলা নিয়ন্ত্রণের সুবিধা রয়েছে। অভিভাবক,আশা করি আপনারা সবাই বুঝতে পারছেন।